|| দয়াল মজুমদার ||
উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে উন্নয়নে অংশগ্রহণ করা| উন্নয়ন তত্ত্বে তাই এখন অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে| জনগণ যদি উন্নয়নে অংশগ্রহণ করেন তাহলে বিকাশের পথ সুগম হয়| এখন আমাদের রাজ্যে যুব সম্প্রদায়ের মানসিকতার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে| সরকারি সহযোগিতা নিয়ে রাজ্যের অনেক যুবক যুবতীরাই উন্নয়নে যেমন অংশ নিচ্ছেন তেমনি নিজেরাও স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন| পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করছেন| অমরপুর মহকুমার জামাল, শিবাজী ও বিকাশ এই তিন যুবক তার অন্যতম নিদর্শন| এই তিন যুবকই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে এখন স্বাবলম্বী|
অমরপুর ব্লকের মৈলাক পঞ্চায়েতের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা জামাল হোসেন, শিবাজী হোসেন ও বিকাশ দেবনাথ| আর্থিক প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করেই তাদের বড় হয়ে ওঠা| সময়ে সময়ে অনেক সাধ জাগলেও সেগুলি পূরণ করতে পারেননিl অষ্টম মান উত্তীর্ণ জামাল এবং দ্বাদশমান অনুত্তীর্ণ শিবাজী ও বিকাশকে পরিবারের আর্থিক প্রতিবন্ধকতার জন্য পড়াশুনায় ইতি টানতে হয়| এই তিনজনের মধ্যেই সময়ে সময়ে নতুন উদ্ভাবনীর বিভিন্ন ভাবনা উঁকি দিলেও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার কারণে তা বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি| এই পরিস্থিতিতে নিজেদের পারিবারিক কৃষি কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন| তবে তার পরেও কোথাও যেন মনের কোনে বাস করেছিলো নতুন উদ্ভাবনী ভাবনা| ঘটনাচক্রে তিনজনই একত্রিত হয়ে আত্মনির্ভরতার পথ খুঁজতে শুরু করলেন| দৃঢ় মানসিকতা তাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পেরেছে| মৈলাকের এই তিন যুবক যৌথভাবে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ করে শুধুমাত্র নিজেরাই স্বাবলম্বী হননি অন্যদেরও রোজগারের পথ তৈরি করে দিয়েছেন| দু’বছর আগে জমি লিজ নিয়ে তারা বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সূচনা করেন| প্রথমে ছোট্ট পরিসরে গড়ে তুললেন চারটি বায়োফ্লক ট্যাঙ্ক| তবে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ। মৎস্য দপ্তরের সহায়তায় ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে স্থানীয় বাজার থেকে দেশি মাগুর, শিং, কই ও তেলাপিয়া মাছের পোনা সংগ্রহ করেন।
প্রতিটি ট্যাংকে দশ হাজার করে মাছের পোনা ছাড়া হয়| ট্যাংক প্রস্তুত করা এবং মাছের পোনা ছাড়ার সাথে সাথে সময়ের প্রয়োজনেই আরও আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জল প্রক্রিয়াকরণ, অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য মিশ্রণ, জলে জন্মানো ব্যাকটেরিয়াকে পুনরায় মাছের খাদ্যে রূপান্তর করার পদ্ধতি সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ নিলেন তারা| বায়োফ্লক পদ্ধতিতে শিং মাছ বছরে দু’বার বাজারজাত করছেন তারা| অমরপুর, উদয়পুর এবং রাজধানী আগরতলার বাজারগুলিতে প্রতি কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় শিং মাছ বিক্রি করে তাদের ভালো রোজগার হচ্ছে| চার থেকে পাঁচ মাস অন্তর অন্তর মাগুর মাছ বাজারজাত করছেন। এই মাছের চাহিদাও রয়েছে বাজারে| প্রতি কেজি মাগুর মাছ প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় অনায়াসে বিক্রি করতে পারছেন| অন্যদিকে তেলাপিয়া মাছ প্রতি কেজি প্রায় ২০০ টাকা দরে বছরে তিনবার বাজারজাত করছেন|
মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের আত্মনির্ভর ত্রিপুরা গড়ার স্লোগানে অনুপ্রাণিত হয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে মৈলাকের এই তিন যুবকের এখন দুই লক্ষ টাকা করে বাৎসরিক আয় হচ্ছে| মৈলাকের আশপাশ এলাকার যুবকরা এখন জামাল, শিবাজীদের দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন| তাদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন| বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে রোজগার বৃদ্ধির তাগিদে জামাল, শিবাজী, বিকাশরা এখন নিজ উদ্যোগে পোল্ট্রি ফার্ম গড়ে তুলেছেন| প্রাণী সম্পদ বিকাশ দপ্তরের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা মোরগ পালন করা শুরু করেছেন| নিজেদের পোল্ট্রি ফার্মে ৩৫ থেকে ৪০ দিন মোরগের ছানা বিজ্ঞান সম্মত ভাবে পালন করে তা বাজারে বিক্রয় করছেন| পোল্ট্রি ফার্ম থেকে তাদের বছরে এক লক্ষ টাকা রোজগার হয়|
রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার তাতে অংশ নিয়ে মৈলাকের এই তিন যুবক আজ আত্মনির্ভর| তাদের আত্মনির্ভরতা অন্যদের কাছে যেমন দৃষ্টান্ত হয়েছে তেমনি আত্মনির্ভর ত্রিপুরা গড়ার দিশা দেখাচ্ছে|