যখনই যেখানে পড়বে বৃষ্টির জল ধরুন

রত্তন লাল কাটারিয়া

শৈশবে, বর্ষার সূচনা শুষ্ক ও দগ্ধ গ্রীষ্মের হাত থেকে যেন নিয়ে আসে বহু কাঙ্খিত মুক্তি। দাবদাহে ঘরের বাইরে খেলতে যাওয়া তপ্ত গনগনে উনুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া-প্রায়শ পায়ে পড়ে ফোসকা। গ্রামের পুকুর ও জলাশয়গুলি যায় শুকিয়ে, বাচ্চারা তাদের গৃহপালিত গরু-বাছুর সঙ্গেঁ নিয়ে যে ঝাঁপিয়ে পড়বে জলে সেই সুযোগটুকু থেকে বঞ্চিত হয়।


বর্ষা আসে আর সেই সঙ্গেঁ বদলে যায় সমগ্র নিসর্গ। প্রথম বর্ষন শষ্যের জন্য নিয়ে আসে বারিধারা, পুকুর ও কুয়োগুলিতে জল জমে, এবং সবচেয়ে বড় স্বস্তি আসে কৃষকদের জন্য। প্রশংসনীয় যে বস্তুত ৬০% কৃষকের ৫৫% কৃষি জমি নির্ভর করে সেচের জন্য বৃষ্টির জলের উপর। পাশাপাশাই বৃষ্টি ধৌত এলাকাগুলোয় দেশের ৬৪ শতাংশ গাই-বাছুর, ৭৮ শতাংশ ভেড়া এবং ৭৮ শতাংশ ছাগল জাতীয় প্রানীরা বেঁচে যায়। তাই, বর্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়াটা ছিল গোটা গ্রামের জন্য একটি পবিত্র পার্বন। পুকুরগুলি কাদা মুক্ত করে পরিষ্কার করা হত সকলে মিলে। মাঠগুলিকে ঠিকঠাক  মতো তৈরী করা হত। কিন্তু আমাদের মতো বাচ্চাদের কাছে হাতের তালুতে বৃষ্টির জলের বিন্দুগুলি তুলত শিহরন এবং ওই “বৃষ্টির জল ধরাটা” ছিল এক মহানন্দের ব্যাপার।


আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসে ডুব দিলে আমরা আবিষ্কার করি যেখানে অপূর্ব সব জলাধার ও সেচের জলাশয় যা মূলত নির্মান করা হয়েছিল যখন জলের ঘাটতি দেখা যেত সেই সব শুখা মরশুমের মোকাবিলা করার জন্য। ওইগুলিকে বিভিন্ন স্থানীয় নাম যেমন বাত্তলি, বাভাদি, ভভ(গুজরাটি), পুষ্কারিনি(কানাড়া), বারভ(মারাঠি)ইত্যাদি শব্দে ডাকা হত। সবচেয়ে প্রাচীন জলাধারের কাঠামোটি নির্মিত হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার যুগে মহেঞ্জোদারোর কছে যা মূলত চোঙাকৃতির ইট দিয়ে বাঁধানো হয়েছিল। প্রথম ঘাটটি নির্মিত হয়েছিল উত্তর ভারতে প্রায় খৃষ্টাব্দ ১০০ বছর আগে। এই সব কাঠামোর অনেকগুলিই সুদক্ষ বাস্তুতন্ত্রের নিদর্শন এবং একাকী বহু ভূমিকম্পের পরও আজ পর্যন্ত টিকে য়েছে। এই সব জলাশয় অনেকগুলি আবার আমাদের পৌরানিক মহাকাব্যগুলির সঙ্গেঁ সম্পর্কিত। এই সব বাত্তরি গুলি আমার সংসদীয় ক্ষেত্রের অন্তর্গত মরনিং পর্বতের কালকা ও তালে অবস্থিত এবং অজ্ঞাতবাস কালে পান্ডবেরা প্রায়শই ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে।


এখন আমরা অন্য যুগে বাস করছি। আমরা ব্যক্তিগত ও উন্নয়ন উভয় কারনেই জল চাই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ আমাদের জলের প্রয়োজনও বহুগুন বেড়ে গেছে। এই চাহিদার একটা বড় অংশ মেটানো হচ্ছে ভূগর্ভের জল উত্তলন করে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারত অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় জলাশয় থেকে জল পাম্প করে তোলার পদ্ধতিতে অনেক বেশি নির্ভরশীল- সারা বিশ্বের ভূগর্ভস্থ জলের যে প্রয়োজন ভারতের ক্ষেত্রে তা চার ভাগের এক ভাগ। মোটামোটি হিসাবে দেখা যায় ভারতে ১.৩৫ বিলিয়ন অধিবাসীর ৮০ শতাংশ পানীয় ও সেচ উভয় কাজের জন্যই ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভর করে। এটা ভূগরভস্থ জলস্তর এতটাই হ্রাস করেছে যা একটা বিপদ সংকেত।


বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮%-এর ঘর হল আমাদের দেশ কিন্তু এর মাত্র ২% হল ভূমি এবং ৪% হল বৈশ্বিক জলসম্পদের অংশ বিশেষ। ভারতে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় ১১ মিলিমিটার হল গড় পরিমান। এর মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতংশ পাওয়া যায় বর্ষাকে। তাই বৃষ্টির জল ধরে রাখাটা একান্তই আবস্যক হয়ে উঠেছে।


একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যদি এই বৃষ্টিপাতের অর্ধেক পরিমান জল ধরে রাখা যায়, তাহলে ভারতের প্রতিটি গ্রাম তার গেরস্থালীর জলের চাহিদা মেটাতে পারে (আর আগরওয়ালের প্রতিবেদন, ২০০১) । অপর একটি সমীক্ষা (ইউ এন-হ্যাবিটেন্ট অ্যান্ড মধ্যপ্রদেশ সরকার) উল্লেখ করেছে যে বাড়ির ছাদে বৃষ্টির জল ধরে রাখলে, ২৫০ বর্গ মিটার আকারের জলাধারে, যে পরিমান জল মজুত হয় তা দিয়ে ৫ জনের একটি পরিবারের সারা বছরের প্রয়োজন মেটে।


বৃষ্টির জল ধরে রাখার এই প্রয়োজনীয়তার কথা অনুধাবন করে মোদী সরকার ২০১৯-এ দেশের ২৫৬-টি জলের অভাব জনিত কারনে চাপ যুক্ত জেলায় জল শক্তি অভিযান (জে এস এ) শুরু করেছে। এ ধরনের প্রচার কর্ম এই প্রথম শুরু করা হয়েছিল যাতে সচিব পর্যায়ের আধিকারিকের নেতৃত্বে সি ডব্লু সি এবং সি জি ডব্লু বি-এর কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল বৃষ্টির জল ধরে রাখার সম্পর্কে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সচেতন করতে ক্ষেত্র পরিদর্শন করেছে। যেহেতু এর সফল মধ্যস্থতার ফছে তাই এর ফলাফলও হয়েছে আশাব্যঞ্জক।


এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১-এর ২২ মার্চ ‘বৃষ্টি জল ধরোঃ যেখানে যখন তা পড়ে’ শিরোনামে দেশ জুড়ে জল শক্তি অভিযান ২(জে এস এ)-এর সূচনা করেছেন। আমাদের লক্ষ্য হল এই নির্দেশিনার অভিমুখে সমস্ত বৃহৎ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ সমূহকে তাদের কার্যক্রমের সুসমান্বিত করা। আমাদের মন্ত্রক ‘বৃষ্টির জল ধরা’-র জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, গ্রামোন্নয়ন, পরিবেশ ও বন, কৃষি, নগর উন্নয়ন, রেল ভারতের বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ, সমস্ত সরকার অধিগৃহীত ক্ষেত্র, সরকারী ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক সমূহ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে হাতে হাতে মেলাতে সুসমন্বয়ে সংঘবদ্ধ করা।


কথায় বলে, নেতৃত্ব হল দিকদর্শনকে বাস্তবে রূপান্তরীত করার ক্ষমতা। মোদী ২.০-এ জল সংরক্ষনকে অগ্রাধীকার দেওয়াটা ছিল শ্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকদর্শন। দ্বিতীয় বারের জন্য শপথ গ্রহন করার অব্যবহিত পরেই জল শক্তি মন্ত্রনালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং সূচনা দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী সমস্ত গ্রাম প্রধানদের এবং পাশাপাশি রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতি এই প্রচার কর্মে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে ও কর্মসূচিটিকে সফল করে তোলার জন্য চিঠি লিখেছেন। আমি এ বিষয়ে প্রত্যয়ী যে জনগনের অংশগ্রহন ও আত্মিক প্রয়াসের ফলে আমরা এই “জল আন্দোলন”-কে “জন আন্দোলনে” রূপান্তরীত করতে পারব। ঋকবেদের একটি শ্লোকে প্রার্থনা করে মেঘকে “পরজন্যা” রুপে সম্ভোধন করে বলা হয়েছে স্বর্গের নন্দন, গগন পুত্র, বলা হয়েছে, ধারিত্রির বুকে বৃষ্টির দান যা এই গ্রহের উপর জীবনের বীজকে অঙ্কুরোদ্গম করার জন্য মূল ভূমিকা গ্রহন করে।


যে এস এ-২-এর ক্ষেত্রে আসুন আমরা সবাই মিলে স্থিতিশীল জীবন এবং পাশাপাশি জীবিকার জন্য ‘বৃষ্টিকে ধরে রাখি’। বস্তুত, যা আমরা আমাদের শৈশবের দিনগুলিতে হাতের তালুতে ধরার চেষ্টা করতাম ওটাই এখন প্রযুক্তিগত মধ্যস্ততা এবং জনগনের অংশগ্রহনের সহায়তায় আরো বৃহৎ আকারে রূপায়িত করা দরকার।
(লেখক কেন্দ্রীয় জল শক্তি মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *