চলে গেলেন শশী কাপুর

কলকাতা, ৪ ডিসেম্বর (হি. স.) : প্রয়াত অভিনেতা শশী কাপুর৷ বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর৷ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি৷ সোমবার সন্ধ্যায় মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়৷ অভিনেতার মৃত্যুতে টুইটে শোকপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ শশী কাপুরের জন্ম কলকাতায়৷ পড়ে ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এর অভিনয় সহ যখনই তিনি এ শহরে এসেছেন, বলছেন তাঁর স্মৃতিমেদুরতার কথা। বিখ্যাত কাপুর পরিবারের অন্যতম সদস্য তিনি। ব্যাপক সংখ্যক হিন্দিভাষী চলচ্চিত্রের পাশাপাশি স্বল্পসংখ্যক ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্রেও তাঁর অংশগ্রহণ রয়েছে। বিখ্যাত অভিনেতা রাজ কাপুর ও শাম্মী কাপুরের ছোট ভাই তিনি। পৃথ্বীরাজ কাপুর তাঁর বাবা। মুম্বইয়ের মাতুঙ্গার ডন বস্কো হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। চার বছর বয়সেই অভিনয়কর্মে সংশ্লিষ্ট হন। পৃথ্বী থিয়েটারে বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুরের পরিচালনায় ও নির্দেশনায় নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৪০-এর দশকের শেষদিকে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু। বাণিজ্যিকধর্মী চলচ্চিত্র ‘সংগ্রাম’, ‘দানা পানি’-তে ‘শশীরাজ’ নামে আবির্ভূত হন। পৌরাণিক চলচ্চিত্রে ওই সময়ে একই নামে আরও একজন শিশু শিল্পী অভিনয় করতো। ‘আগ’ ও ‘আওয়ারা’-তে শিশুশিল্পী হিসেবে স্মরণীয় অভিনয় করেন। ওই সব ছবিতে তাঁর দাদা রাজ কাপুরের ছোটকালের চরিত্রে এবং ১৯৫০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সংগ্রাম’-এ অশোক কুমারের ছেলেবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সময়কালে হিন্দি চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী ছিলেন তিনি। ‘পোস্ট বক্স ৯৯৯’-এ সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এই ছবি সুনীল দত্তের অভিষেক চলচ্চিত্র ছিল। ২০০৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে ওমানের মাস্কাটে অনুষ্ঠিত ‘শশী কাপুর চলচ্চিত্র উৎসব’-এর মধ্যমণি ছিলেন তিনি। ৫৫তম বার্ষিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অনুষ্ঠানে তাঁকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০১১ সালে চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদান রাখার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করেন। একই সালে মোহাম্মদ রফি পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে শশী কাপুর পান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। পৃথ্বীরাজ কাপুর ও রাজ কাপুরের পর কাপুর পরিবারের তৃতীয় সদস্য হিসাবে পান ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা। ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু করে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বলিউডের অত্যন্ত জনপ্রিয় তারকায় পরিণত হন। মোট ১৪১ টি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি৷ ১৯৬১ সালে ‘ধর্মপুত্র’ ছবি দিয়েই অভিনয় জীবনে পা রাখেন শশী কাপুর৷ তাঁর স্মরণীয় ছবি ‘সিদ্ধার্থ’, ‘নমক হালাল’, ‘দিওয়ার’, ‘নিউ দিল্লি টাইমস’ প্রভৃতি. ১৯৬৩ সালে ‘দ্য হাউজহোল্ডার’ ও ‘শেক্সপিয়ারওয়ালার’ মত ইংরেজি ছবিতে অংশ নেন। অভিনেত্রী নাদিরার সাথে আবেগময় চলচ্চিত্র ‘চার দিওয়ারি’ এবং ‘মেহেন্দি লাগি মেরে হাত’-এর মত সামাজিক চলচ্চিত্রে অংশ নিয়ে সাড়া জাগান। ১৯৬০-এর দশকে অভিনেত্রী নন্দা’র সাথে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে জুটি গড়েন. ১৯৯০-এর দশকে এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নন্দা তাঁর প্রিয় নায়িকা এবং অন্যতম পরামর্শদাত্রী ছিলেন। অন্যদিকে, নন্দাও শশী কাপুরকে তাঁর প্রিয় নায়করূপে স্বীকার করেন। ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাখী, শর্মিলা ঠাকুর, জিনাত আমানের সাথে জুটি গড়েন। এছাড়াও, হেমা মালিনী, পারভিন ববি ও মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়ের সাথেও নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। তন্মধ্যে, হেমা মালিনীর বিপরীতে ১০টি চলচ্চিত্রে ছিলেন। বহু নায়ক নিয়ে গড়া ‘প্রেম কাহানী’-তে রাজেশ খান্নার সাথেও কাজ করেছেন। ১৯৭৮ সালে নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘জুনুন’, ‘কলিযুগ’, ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’, ‘বিজেতা’ ও ‘উৎসব’ তৈরি করেন। ১৯৯১ সালে তাঁর নির্দেশনায় ও পরিচালনায় ‘আজুবা’ মুক্তি পায়। এতে তিনি সহনায়ক হিসেবে অমিতাভ বচ্চন ও ভাইপো ঋষি কাপুরের সাথে অংশ নেন। চলচ্চিত্র জীবনের শুরু থেকে নন্দা, প্রাণ, ধর্মেন্দ্র, দেব আনন্দ, ইসমাইল মার্চেন্ট, রাজেশ খান্না, সঞ্জীব কুমার তাঁর নিকটতম বন্ধু ছিলেন। এছাড়াও, অমিতাভ বচ্চন, যশ চোপড়া, এমজিআর, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকরসহ অনেকের সাথেই জানাশোনা ছিল তাঁর। ১৯৮৭ সাল থেকে খুব কমই অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে পিয়ার্স ব্রসনানের সাথে দ্য ডিসিভার্স চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৯৪ সালে মুহাফিজ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় পুরস্কার বিশেষ লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে গালিভার্স ট্রাভেলসের টেলিভিশন সংস্করণে রাজা চরিত্রে ছিলেন। চলচ্চিত্রে তাঁর সর্বশেষ ও সাম্প্রতিক অংশগ্রহণ ছিল ১৯৯৮ সালের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র আত্মজীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘জিন্নাহ’। ওই চলচ্চিত্রে তিনি অনুবাদক ছিলেন। এ ছাড়াও, ‘মার্চেন্ট আইভরি প্রোডাকশন্স’ থেকে একই সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাইড স্ট্রিটস’-এও একই ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে পুরোপুরিভাবে অবসর নেন। এর পর থেকে তাঁকে আর কোনও চলচ্চিত্রে অংশ নিতে দেখা যায়নি। বার্ধক্যজনীত সমস্যায় বহুদিন ধরেই ভুগছিলেন শশী কাপুর৷ ভর্তি ছিলেন মুম্বইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালে৷ দীর্ঘদিন সিনেমা থেকে দূরেই ছিলেন তিনি। পারিবারিকভাবে সিনেমা জগতের মানুষ হলেও শশী কাপুরের তিন সন্তান করণ কাপুর, কুণাল কাপুর, ও সঞ্জনা কাপুর সিনেমা জগতে তেমন একটা পা রাখেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *