মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরেছেন ব্যাঙ্ক কর্মীরা রহস্যে ঘেরা অপহরণ কান্ডে গ্রেপ্তার নয়জন

চক্রের পান্ডাদের অনেকেই প্রাক্তন জঙ্গী, জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধার হল ৫০ লক্ষ টাকা
নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা/তেলিয়ামুড়া, ২ ডিসেম্বর৷৷ রহস্যে ঘেরা অপরহণ কান্ডে চড়া মুক্তিপণের বিনিময়েই ফিরে আসতে পেরেছেন অপহৃতরা৷

অপহরণ কান্ডের পান্ডাদের বিরুদ্ধে পুলিশের তল্লাশী অভিযান আগরতলায় (বাঁয়ে), তেলিয়ামুাড়ায় এই চক্রের পান্ডাদের দুইজন (উপরে ও নীচে)৷ শনিবার তোলা ছবি নিজস্ব৷

এদিকে, আগরতলা, মুঙ্গিয়াকামী এবং তৈদুর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অপহরণকান্ডে জড়িত সন্দেহে নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মুক্তিপণ বাবদ আদায় করা ৫০ লক্ষ টাকাও উদ্ধার হয়েছে বলে সূত্রের খবর৷ পঞ্চাশ লক্ষ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরে এসেছেন গ্রামীণ ব্যাঙ্কের তৈদু শাখার চার কর্মী৷ শনিবার ধলেশ্বর স্থিত নিজ বাসভবনে একথা জানালেন মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরে আসা গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কর্মী রক্তিম ভৌমিকের বাবা রতন ভৌমিক৷ পাশাপাশি অপহৃত চারজনের ফিরে আসার পেছনে পুলিশের কৃতিত্ব রয়েছে বলে মানতে রাজি নন তিনি৷ বরং রাজ্য সরকারের কাছে তিনি মুক্তিপণ বাবদ দেওয়া পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন৷ এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে অপহরণের পর জঙ্গি ডেরায় কাটানো দিনগুলির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন রক্তিম ভৌমিক৷ তবে, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের চার কর্মীর অপহরণ কাণ্ড খুবই রহস্যজনক বলেও মনে করা হচ্ছে৷ কারণ, মুক্তিপণের টাকা আদায়ের মাধ্যম হিসেবে অপহরণকারীরা অপহৃত সুব্রত দেববর্মার বাড়িকে ব্যবহার করেছে৷ শনিবার পুলিশ আগরতলায় প্রগতি রোড থেকে জি এন দেববর্মা এবং শ্যামলী বাজার এলাকা থেকে রাকেশ দেববর্মাকে অপহরণকান্ডে জড়িত সন্দেহে আটক করে৷ জি এন দেববর্মার বাড়ি থেকে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে সূত্রের খবর৷ এদিকে, মুঙ্গিয়াকামী থানার পুলিশ দুপুর একটা নাগাদ ঐ অপহরণকান্ডে জড়িত সন্দেহে সুরেন্দ্র দেববর্মা এবং লক্ষ্মীচরণ দেববর্মাকে আটক করে৷ ধৃত চারজনকেই তৈদু থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে৷ এদিকে, রাত পর্যন্ত তৈদু এলাকায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ তুইচাকমা এলাকা থেকে শচীন্দ্র দেববর্মা, রাজেন্দ্র দেববর্মা, অভিমুন্য দেববর্মা, কর্ণ দেববর্মা এবং সন্দীপ দেববর্মাকে অপহরণ কান্ডে জড়িত সন্দেহে আটক করে৷ রাতে ঐ নয়জনকেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে৷ আগামীকাল তাদের আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে৷ এদিকে, ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে মুক্তিপণ বাবদ আদায় করা ৫০ লক্ষ টাকাও উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে৷ ধৃতরা ভারত তুইপ্রা এসোসিয়েশনের সদস্য বলে রাজ্য পুলিশের জনৈক আধিকারীক জানিয়েছেন৷ জেরায় এই তথ্য উঠে এসেছে বলে তিনি দাবি করেছেন৷ ঐ আধিকারীকের বক্তব্য ধৃত নয়জনের মধ্যে সাতজন আত্মসমপর্ণকারী জঙ্গী৷ এদিকে, আগরতলাায় ধলেশ্বর ১১ নং রোডস্থিত নিজ বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে রক্তিম বাবু জানান, অন্যান্য দিনের মত সেদিনও তাঁরা ব্যাঙ্কের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন৷ কিন্তু, সেদিন পথে গাছের লক ফেলে রেখে তাঁদের পথ আটকে দেয় অপহরণকারীরা৷ বন্দুকের নলের মুখে তাঁদের চারজনকে অপহরণ করা হয়৷ অপহরণকারীরা সকলেই মুখে কালো কাপড় বেঁধে রেখেছিল৷ তাই অপহরণকারিদের কাউকেই তাঁরা চিনতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন৷ রক্তিমবাবু বলেন, অপহরণকারীরা সেনাবাহিনীর পোষাকে ছিল এবং তাদের সকলের হাতেই বন্দুক ছিল৷ তিনি আরো জানান, তাঁদের অপহরণ করার পর চোখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল৷ নিয়ে যাওয়ার সময় হাতও দঁড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়৷ ফলে, তাঁদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানাতে পারেননি৷ অপহরণ করার পর তাঁদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন৷ রক্তিমবাবু বলেন, অপহরণের পর দুই দিন তাঁদের দু’বেলা করে খেতে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু এরপর থেকে দিনে একবার তাঁদের খেতে দেওয়া হয়েছে৷ অপরিশ্রুত পানীয়জল তাঁদের পান করতে হয়েছে৷ হাজার কষ্ট তাঁরা মুখ বুঝে সহ্য করেছেন, কারণ তাঁদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল৷ মুক্তিপণের টাকা না মিললে তাঁদের হয় বাংলাদেশে পাঠানো হবে, নয়তোবা মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল৷ তিনি জানিয়েছেন, মুক্তিপণের টাকা বন্দোবস্ত করার জন্য তাঁরা তাদের বাড়িতে অপহরণকারীদের নির্দেশে ফোন করেছিলেন৷ রক্তিমবাবু জানান, প্রতিদিন তাঁদের জায়গা বদল করা হত৷ অবশেষে গত বৃহস্পতিবার তাঁদেরকে জানানো হয় মুক্তিপণের টাকা দিতে প্রস্তুত তাঁদের পরিবার তাই ওইদিনই সকলকে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ সে মোতাবেক সেদিন রাতে তাঁদেরকে দুই বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়ে অজানা স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ অনেকটা দূর হেঁটে আসার পর তাঁরা পাহাড়ে ঘেরা একটি গ্রাম লক্ষ্য করেন এবং সেখানে একটি বাড়ির সামনে সাদা রঙের ম্যাক্স গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পান৷ তাঁরা সেই বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মালিককে অনেকবার ডাকাডাকি করার পর তিনি বেড়িয়ে আসেন এবং তাঁদের চিনতে পারেন৷ রক্তিমবাবু জানান, সেদিন রাতে ঐ বাড়িতেই তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং পরদিন ভোরে তাঁদেরকে অম্পিতে পৌঁছে দেন সেই বাড়ির মালিক৷ তিনি জানান, অম্পিতে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের তৈদু শাখার আধিকারিক তন্ময় দেবের বাড়িতে যান৷ সেখান থেকে তারা তৈদু থানায় যোগাযোগ করেন এবং নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন৷ এদিন রক্তিম ভৌমিকের বাবা রতন ভৌমিক জানান, মুক্তিপণের টাকা যোগার করতে তাঁদের ভীষণ সমস্যা হয়েছিল৷ তিনি জানান, অপহরণের পর প্রথমে রাজ্যপুলিশ খুবই সক্রিয় বলে তাঁর মনে হয়েছিল৷ কিন্তু, অপহৃতদের উদ্ধারে পুলিশের তেমন কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি৷ তিনি বলেন, মুক্তিপণ ছাড়া তাঁদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না৷ রতনবাবু বলেন, তনুময় ভট্টাচার্য্য, সুজিত দের পরিবার এবং তিনি মিলে মুক্তিপণের পঞ্চাশ লক্ষ টাকা বন্দোবস্ত করেন৷ অপর অপহৃত সুব্রত দেববর্মার পরিবারের সাথে মুক্তিপণের টাকার বিষয়ে কোন যোগাযোগ তাঁদের হয়নি৷ কিন্তু, মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে অপহরণকারীরা সুব্রত দেববর্মার বাড়িটিকে বেছে নিয়েছিল৷ তিনি জানান, অপহরণকারীরা মুক্তিপণের টাকা সুব্রত দেববর্মার বাড়িতে দিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল৷ সেই মোতাবেক বৃহস্পতিবার পঞ্চাশ লক্ষ টাকা সুব্রত দেববর্মার বাড়িতে দিয়ে আসা হয়৷ অবশ্য সুব্রত দেববর্মার ভাই এই টাকা রাখার দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না৷ কিন্তু অপহরণকারীদের নির্দেশ মোতাবেকই মুক্তিপণের টাকা সুব্রত দেববর্মার বাড়িতে রেখে আসা হয় বলে জানান রতনবাবু৷ সেই দিনই তাঁদের সন্তানদের মুক্তি দেওয়া হবে বলে অপহরণকারীরা জানিয়েছিল৷ অবশেষে শুক্রবার সকালে চার অপহৃত ব্যাঙ্ক কর্মী বাড়ি ফিরে আসেন৷ এদিন রতনবাবু রাজ্য সরকারের কাছে মুক্তিপণ বাবদ দেওয়া টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন৷ এদিকে এই অপহরণ কাণ্ডে শুধুই কি সন্ত্রাসবাদিদের যোগ রয়েছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোন রহস্য আছে তা তদন্ত কার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বলা মুসকিল৷ অপহরণকারীরা মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে অপহৃত সুব্রত দেববর্মার বাড়িকে কেন বেঁছে নিয়েছিল তাও সন্দেহের উধের্ব নয় বলে মনে করছে তথ্যবিজ্ঞ মহল৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *