টানা বর্ষণে ফের বন্যা, প্লাবিত ছয় জেলা, আট সহশ্রাধিক ত্রাণ শিবিরে

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, খোয়াই, তেলিয়ামুড়া, আমবাসা, উদয়পুর, বিলোনীয়া, চড়িলাম, বিশালগড়, ২২ অক্টোবর৷৷

খোয়াই জেলায় ভারী বর্ষণে জলমগ্ণ বাড়িঘর৷ রবিবার তোলা নিজস্ব ছবি৷

ফের রাজ্যে ভারী বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে৷ গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে পশ্চিম, ঊণকোটি, খোয়াই, সিপাহিজলা, গোমতী এবং দক্ষিণ ত্রিপুরায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ বন্যার কবলে পরে প্রায় ৮ হাজারের উপর মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে৷ প্রশাসনিক সূত্রে খবর, সারা রাজ্যে ৬১টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে৷ তাতে প্রায় ২২০৩ টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে৷ এদিকে, খোয়াই এবং গোমতী নদীর জল বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে৷ সদর মহকুমায় ১৭টি ত্রাণ শিবিরে ৮১৭ পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে৷ এদিকে, উদয়পুরে গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত মোট ১৪ টি ত্রাণ শিবিরে ১৭০ পরিবারের ৬৭০ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে৷ এছাড়াও বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছে৷
সদর মহকুমা শাসক জানিয়েছেন, গতকালকের তুলনায় আজ নিচু এলাকায় জল অনেকটা নেমে যাওয়ায় কয়েকটি পরিবার বাড়ি ফিরে যাবে৷ তবে, বলদাখাল, প্রতাপগড়ের বিস্তির্ণ এলাকা এখনো জলমগ্ণ রয়েছে৷ জানাগেছে, গোমতী জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কাকড়াবন ব্লক এলাকায়৷ সেখানে ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৫টি এডিসি ভিলেজে প্রায় পাঁচ হাজার কৃষকের ফসল নষ্ট হয়েছে৷ তাছাড়াও, বন্যা কবলিত বিভিন্ন কৃষি প্রধান এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ বহু পুকুর ডুবে যাওয়াতেও মাছ ভেসে গেছে৷
এদিকে, উদয়পুর থেকে মির্জা যাওয়ার পথে একটি লোহার সেতু জলে তলায় ডুবে যাওয়ায় ঐপথে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে৷ ধলাই জেলাতে তেমন কোন প্রভাব না পড়লেও কমলপুর থেকে আমবাসা যাওয়ার পথে কুলাই এলাকায় ধলাই নদীর উপর লোহার সেতুটির একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ গতকাল রাতের ভারী বর্ষণে সেতুটির একটা অংশ মাটি থেকে আলগা হয়ে গেছে৷ তাতে, সেতুটি ভেঙ্গে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ তাই এই পথে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ কমলপুর থেকে আমবাসা যাওয়ার জন্য বিভিন্ন যানবাহন বিকল্প পথ ধরে যাতায়াত করছে৷

বিশালগড়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রেল লাইন৷ নিজস্ব ছবি৷

এদিকে দক্ষিণ জেলাতেও ভারী বর্ষণে বিরাট প্রভাব ফেলেছে৷ বিলোনিয়া এবং শান্তির বাজারে মূল সড়ক জলমগ্ণ হয়ে পড়েছে৷ স্থানীয় প্রবীনদের বক্তব্য, বিগত ৩০ বছরে এধরণের ভয়াবহ বন্যা দেখা যায়নি৷ মূলত গতকাল রাতের ভারী বর্ষণে ফেনি নদীর উপর বাঁধ ভেঙ্গে যায়৷ তাতে, নদীর জল উল্টাদিকে প্রবাহিত হয়৷ এর ফলে বিলোনিয়া শহর জলমগ্ণ হয়ে পড়ে৷ অধিকাংশ রাস্তা চলাচলের উপযোগী নয়৷ জানা গেছে, বিলোনিয়ায় রামঠাকুর পাড়া, আমলাপাড়া, মাস্টার পাড়া, আর্যসমাজ এবং রামকৃষ্ণ কলোনী এলাকায় প্রচুর জল জমে রয়েছে৷ কোন দিকে দিয়েই জল নামছে না৷ ফলে, বিলোনিয়া থেকে ঋষ্যমুখ যাওয়ার জন্য বিভিন্ন যানবাহন ফাড়ি পথ অবলম্বন করছে৷ আমজাদ নগরে ৪২টি পরিবারকে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে৷ এদিকে শান্তির বাজার মহকুমায় জুলাইবাড়ি, লাউগাঙ, বেতাগা প্রভৃতি এলাকা জলমগ্ণ হয়ে পড়েছে৷ মোট ১১৯ টি পরিবারকে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে৷
এদিকে, তিনদিনের মুষলধারে বৃষ্টিতে বিশালগড় মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার কবলে পড়েছে সহাশ্রাধিক পরিবার৷ বিশালগড়ের মহকুমা হাসপাতাল থেকে শুরু করে থানা, উত্তর বাজার ও লালসিংমুড়া যাওয়ার স্টেশন এবং জাঙ্গালীয়া পর্যন্ত জাতীয় সড়ক সকাল থেকে চারটা অবধি জলমগ্ণ হয়ে রয়েছিল৷ ছোট গাড়িগুলো চলাচল সম্পূর্ণ ভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়৷ শুধুমাত্র বড়গাড়ি গুলো চলাচল স্বাভাবিক হয় দুপুর দুটোর পর থেকে৷ যাত্রীদের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না৷ বিশালগড় পুর পরিষদের উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে চিড়াগুড় ও বাতাসা বন্টন করা হয়৷ অন্যদিকে চড়িলামে ক্ষতিগ্রস্ত পঞ্চায়েতের মধ্যে দক্ষিন চড়িলাম ১নং ওয়ার্ডের অর্ন্তগত কড়ইমুড়া ও রেলব্রীজ সংলগ্ণ ১২৪ পরিবারের ৬১৫ জন৷ ২নং ওয়ার্ডের ৩টি বসত ঘড় সম্পূর্ণ ভাবে ভূপাতিত হয়ে পড়েছে৷ এলাকারই বাসিন্দা সঞ্জিব পাল, স্বপ্ণা দে(নাগ) এবং অশোক দত্ত একই ওয়ার্ডের আরও ৪টি বসতঘড়ের আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ উত্তর চড়িলাম গ্রাম পঞ্চায়েতের ১,২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮ এবং ওয়ার্ডের ১৯৬ পরিবারের ৯৬৬ জন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ লালসিংমুড়ার ৪ ও ৫ নং ওয়ার্ডের গোপাল সাহা পাড়া এবং মদন দেববর্মা পাড়া দুটি পাড়ায় ১১ পরিবারের ৫৫ জন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ ছেচরিমাই এর থালাভাংগা ও পরিমল চৌমুহনী সংলগ্ণ এলাকায় ৫০ পরিবারের ২১০ জন, রামছরার রাঙ্গাপানীয়া সংলগ্ণ এলাকার ১৫ পরিবারের ৭০ জন এবং উত্তর ব্রজপুরের ১নং ওয়ার্ডে দরগামুড়ার ১৫ পরিবারের ৭৬ জন বন্যার প্রকোপে পড়েছে৷ চড়িলামে সর্বমোট ৪১১ পরিবারের ১৯৯২ জন বন্যার প্রকোপে পড়েছে৷ তাদের প্রশাসনের তরফে ৫০০ কেজি চিড়া, ২০০ কেজি গুড় বিলি করেছে বলে জানান ব্লক আধিকারিক শান্তনু বিকাশ দাস৷ তাছাড়া উত্তর চড়িলামে লীলা দেব স্মৃতি কমিউনিটি হলে ত্রান শিবির খোলা হলেও কোন শরনার্থী ত্রান শিবিরে আশ্রয় নেন নি৷ বন্যায় জল কমতে শুরু করেছে কিন্তু কড়ইমুড়াস্থিত রেলব্রিজ সংলগ্ণ এলাকায় রেললাইনে মাটি ধবসে পড়ায় রেলচলাচল অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে৷
খোয়াই জেলাতেও নদীর জল রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর ডুবে গেছে৷ প্লাবিত হয়েছে খোয়াই মহকুমার শহরাঞ্চল৷ প্লাবিত গ্রামাঞ্চল৷ খোয়াই জেলা এখন জলে টইটুম্বুর৷ এদিকে খোয়াই বনকর এলাকা, হাসপাতাল পাড়া, কাঞ্চনঘাট, পহরমুড়া, আমলা পাড়া, সোনাতলা সহ বেশ কিছু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে৷ বন্যার কবলে পড়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে খোয়াই মহকুমা প্রশাসনের ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ৷ বন্যা দূর্গতদের উদ্ধার কার্যে পুলিশ, টিএসআর, অগ্ণিনির্বাপক দপ্তরের কর্মীরা নেমে পড়েছেন রবিবার সকাল থেকেই৷ নৌকা নিয়ে চলছে উদ্ধার কার্যে৷ বন্যা কবলিত মানুষজনদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রশাসন তৎপরতার সাথে কাজ করে চলছে৷ বন্যা দূর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে মহকুমা প্রশাসন এবং স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতৃত্বরা৷ প্রাথমিকভাবে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে খোয়াই সরকারী বালিকা বিদ্যালয়, শ্রীনাথ বিদ্যানিকেতন, জিএবি ক্লাব, শ্রীকৃষ্ণ মিশন সুকল, সোনাতলা পঞ্চায়েত অফিসে৷ বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করতে ত্রাণ শিবিরগুলিতে ছুটে গেছেন মহকুমা শাসক প্রসূন দে৷
এদিকে খোয়াই জেলার অন্তর্গত কল্যাণপুর ব্লক এলাকাতেও বন্যার কবলে পড়ে মানুষজন বাড়ী-ঘর ছাড়া৷ রতিয়া খেয়াঘাট সংলগ্ণ খোয়াই-তেলিয়ামুড়া সড়কে ব্যাপক ভাঙন ধরেছে৷ জলে থৈথৈ করছে কল্যাণপুরের বেশ কিছু এলাকা৷ গৌরাঙ্গটিলা, লক্ষীনারায়ণপুর এলাকাও প্লাবিত৷ লক্ষীনারায়ণপুর এলাকায় রাস্তা আর নদী সমান হয়ে আছে৷ চারমাস বয়সে দ্বিতীয়বার শরনার্থী শিবিরে এই ছোট বাচ্চাটি৷ প্রথমবার ১২ দিন বয়সে৷ দ্বিতীয়বার বন্যা ত্রাণ শিবিরে এল প্রায় চার মাসের কাছাকাছি সময়ে৷