নিজস্ব প্রতিনিধি, কাঞ্চনপুর, ৮ অক্টোবর৷৷ হজাগিরি নৃত্য হচ্ছে ত্রিপুরার ঐতিহ্য৷ আমাদের গর্ব৷ শুধু আমাদের দেশেই নয় বিশ্বের দরবারেও ব্রু জাতি গোষ্ঠির হজাগিরি নৃত্য সমাদৃত৷ হজাগিরি নৃত্য নিয়ে আমাদের রাজ্যে ২৫ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে হজাগিরি উৎসব৷ গতকাল কাঞ্চনপুর মহকুমার গছিরামপাড়ায় ২৫ তম হজাগিরি উৎসবের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এ কথা বলেন৷ ব্রু সোসিও কালচারেল অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে৷ ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংসৃকতি দপ্তর, আদিম জাতি কল্যাণ, উপজাতি কল্যাণ দপ্তর এবং এ ডি সি প্রশাসন এই উৎসব আয়োজনে সহযোগিতা করেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার ছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আদিম জাতি কল্যাণ মন্ত্রী মনীন্দ্র রিয়াং বিধায়ক রাজেন্দ্র রিয়াং, এ ডি সি’র কার্য্যনির্র্বহী সদস্য রাজেন্দ্র রিয়াং, এ ডি সি সদস্য ললিত দেনবাথ ও উত্তর ত্রিপুরা জেলার জেলা শাসক শরদিন্দু চৌধুরী৷ হজাগিরি উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন সাংসদ বাজুবন রিয়াং৷ স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্রু সোসিও কালচারেল অর্গানাইজেশনের সাধারণ সম্পাদক ড লিংকন রিয়াং৷
দু’দিন ব্যাপী ২৫ তম হজাগিরি উৎসবের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, এই উৎসব ত্রিপুরায় উপজাতি, অনুপজাতি, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সকল ধর্মাবলম্বী, সকল ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ঐক্য-চেতনা, সংহতি চেতনা সম্প্রীতি চেতনাকে সুসংহত হতে, সুদৃঢ় করতে সাহায্য করবে৷ এই উৎসব আমাদের রাজ্যের সমৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করবে৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ৷ পৃতিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার রাষ্ট্র৷ এই দেশের মধ্যে নানা ধর্ম, নানা বর্ণ, নানা সম্প্রদায়ের মানুষের বাস৷ প্রত্যেক ভাষার, প্রত্যেক ধর্মের, প্রত্যেক বর্ণের নিজস্ব সংসৃকতি রয়েছে, ঐতিহ্য আছে, কৃষ্টিগত ঐতিহ্য আছে৷ কিন্তু এই বৈচিত্রের মধ্যেও ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে এক সংহতি আছে৷ ঐক্য আছে৷ এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের দেশের সংবিধানের অন্তর্নিহিত বক্তব্যের এবং বৈশিষ্টের জন্য৷ তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের মূল ভিত্তি হচ্ছে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা৷ গণতন্ত্রের মূল কথা হলো আমরা স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারব, স্বাধীন ভাবে ভালোকে ভালো করতে পারব, মন্দকে মন্দ বলতে পারব৷ এই অধিকার দেশের সংবিধান আমাদের দিয়েছে৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা হলো আমাদের দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যমন্ডিত দৃষ্টিভঙ্গী৷ সেই জন্য ধর্মের নামে কোন রাজনৈতিক দল এখানে করা যাবেনা৷ রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কর্মসূচী, অর্থনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করবে৷ তিনি বলেন, ভারতবর্ষ একটি বৃহৎ রাষ্ট্র৷ এখানে নানা জাতি, ধর্ম, বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন৷ প্রত্যেকেরই ঐতিহ্য, সংসৃকতি ও কৃষ্টি ভিন্ন ভিন্ন৷ কিন্তু এই বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে মিলন৷ এটা আমাদের আবহমানকালের ঐতিহ্য৷ আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা ও বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ঐতিহ্যকে চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্র যদি কোন নির্দিষ্ট ধর্মকে আনুগত্য দেখায় তাহলে অন্য ধর্মের মানুষ আঘাত পাবেন৷ তারা ভাবতে পারেন এই দেশ আমার না৷ তিনি বলেন, ব্রিটিশরা এক সময় ভারতবাসীকে ধর্মের নামে, বর্ণের নামে আলাদা করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল৷ ব্রিটিশদের হাতে খন্ডিত ভারত যাতে আর ভাগ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের সংবিধান তৈরী হয়েছে৷ তিনি বলেন, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে শিক্ষার সুযোগ এই কাঞ্চনপুর এলাকায় ছিলো না বললেই চলে৷ এখন এই সুযোগ অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে৷ আরো অনেক কিছু করার রয়েছে৷ লোাকর লোকের সহযোগিতা পেলে নতুন নতুন আরো অনেক কাজ সম্পন্ন হবে৷
মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন টাকার দাম কমছে, জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে৷ কৃষকরা আত্মহত্যা করছে৷ এই সব জলন্ত সমস্যা নিয়ে দেশের সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই৷ তারা রাষ্ট্রের ধর্ম কি হবে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে৷ গো রক্ষার নামে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে৷ আমরা কিসের মাংস খাব কিশের মাংস খাবনা এ নিয়ে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে৷ এই নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে৷ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিষ এ রাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হবে না৷ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবেই এর প্রতিরোধ করবেন৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন ত্রিপুরার স্লোগান আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে৷ রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে৷ শান্তির পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখে উন্নয়ন ধারাকে এগিয়ে নিতে মুখ্যমন্ত্রী যে কোন মূল্যে জাতি-উপজাতির ঐক্যের চেতনা রক্ষা করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন৷
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে পাঁচ হাজার এক টাকার একটি চেক মুক্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়৷ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী হজাগিরি উৎসব উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি স্মরণিকা আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন৷ অনুষ্ঠানে আদিম জাতি কল্যাণ মন্ত্রী মণীন্দ্র রিয়াং বলেন, নতুন প্রজন্মোর কাছে ঐতিহ্যবাহী হজাগিরি নৃত্য ও জনজাতিদের কৃষ্টি ও সংসৃকতি তুলে ধরা প্রয়োজন৷ তিনি বলেন, শিক্ষা ও সংসৃকতির বিকাশ ছাড়া কোন জাতি বা সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়৷ অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রাক্তন সাংসদ বাজুবন রিয়াং বলেন, হজাগিরি উৎসব মিলনের উৎসব, আনন্দের উৎসব৷ রাজ্য সরকার এই রাজ্যের উপজাতিদের কৃষ্টি ও সংসৃকতির বিকাশে ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে৷
2017-10-08