স্বাভাবিক হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি, ঘুরে দেখলেন মুখ্যমন্ত্রী, গঠিত কমিটি

দশ সহস্রাধিক পরিবার ত্রাণ শিবিরে, উদ্ধারকার্য চলছে

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১২ আগষ্ট৷৷ বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে৷ তবে, বহু এলাকা এখনো জল প্লাবিত৷ বন্যায় তিন জেলায় দশ সহশ্রাধিক পরিবার ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে৷ উদ্ধারকার্য এখনো শেষ হয়নি৷ শনিবার মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেলনে রাজস্ব মন্ত্রী বাদল চৌধুরী জানান, বন্যায় ১০৩০২টি পরিবার ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে৷ পশ্চিম জেলা, সিপাহীজলা জেলা এবং খোয়াই জেলায় মোট ৬৮টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে৷ এদিকে, বন্যায় সিপাহীজলা এবং খোয়াই জেলায় ২৯টি বাড়ি পুরো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং ৩৬টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ চারজন আহত হয়েছেন৷ তাঁদের এখন চিকিৎসা চলছে৷
তিনি জানান, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পশ্চিম ত্রিপুরায়৷ মোট ৯২৭৪টি পরিবার ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে৷ ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে ৫৩টি৷ এর মধ্যে সদরে ৩৬টি, মোহনপুরে ৩টি এবং জিরানীয়ায় ১৪টি ত্রাণ শিবির রয়েছে৷ তিনি বলেন, এখনো অনেককে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি৷ উদ্ধারকার্য চলছে৷ তাঁর বক্তব্য, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েও অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে আসতে চাইছেন না৷ তবে, তাঁদের বোঝানো হচ্ছে৷
এদিকে, আজ মহাকরণে রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির পর্যালোচনা সভায় মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, প্রশাসনকে সর্বতোভাবে বন্যাকবলিত দুর্গত মানুষকে সাহায্য করতে হবে৷ এই সাহায্যের ক্ষেত্রে যেন কোনও সংকীর্ণতার অবকাশ না থাকে৷ মানুষের পাশে থাকতে হবে প্রশাসনকে৷ মানুষের এই বিপদের সময়ে এটাই হবে আমাদের প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব৷ আজ সকালেই আগরতলা শহরে হাওড়া নদীর তীরবর্তী বন্যাকবলিত এলাকাগুলো তিনি পরিদর্শন করেন৷ এসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজস্ব দফতরের মন্ত্রী বাদল চৌধুরী৷ বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে মহাকরণে ফিরে এসে তিনি বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলা নিয়ে একটি পর্যালোচনা সভা করেন৷ সভায় রাজস্ব দফতরের মন্ত্রী বাদল চৌধুরী, নগরোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী মানিক দে, পানীয় জল ও স্বাস্থ্যবিধান দফতরের মন্ত্রী রতন ভৌমিক, আগরতলা পুর নিগমের মেয়র ড প্রফুল্লজিৎ সিনহা, মুখ্যসচিব সঞ্জীব রঞ্জন, রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক এ কে শুক্লা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন৷ সামগ্রিক পর্যালোচনার পর বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেবার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যসচিব সঞ্জীব রঞ্জনের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন৷ মুখ্যসচিব ছাড়াও এই কমিটিতে রয়েছেন রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক এ কে শুক্লা, রাজস্ব দফতরের প্রধান সচিব সুশীল কুমার, অর্থ দফতরের প্রধান সচিব এম নাগারাজু, স্বাস্থ্য দফতরের সচিব এস ভৌমিক, পশ্চিম জেলার জেলা শাসক ও পুলিশ সুপার, আগরতলা পুর নিগমের চিফ এক্সিটিউটিভ অফিসার এবং ডি ডব্লু এস দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার৷ এই প্রশাসনিক কমিটির বাইরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নেবার জন্য একটি কোর কমিটিও করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে এই কমিটিতে আছেন পুলিশের মহানির্দেশক এবং রাজস্ব ও অর্থ দফতরের প্রধান সচিবগণ৷ বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় এবং বন্যা দুর্গতদের সাহায্যদানে প্রশাসনিক স্তরে সঠিকভাবে সমন্বয় রেখে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷
বন্যা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক পদক্ষেপ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী বেশ কয়েকটি নির্দেশ দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, বন্যাকবিলত এলাকায় দুর্গত মানুষকে উদ্ধারের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে৷ উদ্ধারের জন্য দুর্গতদের তরফ থেকে আবেদন আসার সঙ্গে সঙ্গেই সাহায্য করতে হবে৷ ত্রাণ শিবিরগুলোতে রান্না করা খাবার সরবরাহ অব্যাহত রাখতে বলেছেন তিনি৷ বিশেষ করে শিশুদের খাবারের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন৷ যেসমস্ত বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষ এখনও ত্রাণ শিবিরে না এসে নিজেদের বাড়িতে কিংবা আশেপাশে রয়েছেন কিন্তু রান্নাবান্না করার পরিবেশ নেই সেখানে দুর্গত মানুষদের কাছে প্রয়োজনে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিতে প্রশাসনকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন৷ শিবিরগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে স্যানিটেশনের যথাযথ ব্যবস্থা করতে বলেছেন তিনি৷ মেডিক্যাল টিমের সংখ্যা আরও বাড়াতে বলেছেন তিনি৷ প্রয়োজনে পাশাপাশি অবস্থিত কয়েকটি ত্রাণ শিবিরকে নিয়ে একটা সেন্টার তৈরি করে স্বাস্থ্য বিষয়ে নজরদারী চালাতেও বলেছেন তিনি৷ এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও পুর নিগমের সাহায্য নিতে স্বাস্থ্য সচিবকে পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ত্রাণ শিবিরগুলোতে পর্যাপ্ত আলো এবং পুরুষ ও মহিলা নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন৷ বন্যাকবলিত এলাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে সেখানে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিশ্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এক্ষেত্রে পুর নিগমকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও বলেছেন তিনি৷ হাওড়া ও কাটাখালের বাঁধের নজরদারী বাড়াতে পুলিশের মহানির্দেশককে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ পাশাপাশি আগরতলা শহরে দিনরাতে পুলিশ পেট্রোলিং এর ব্যবস্থা বাড়াতেও বলেছেন তিনি৷ বিদ্যুৎ সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখতে দফতরকে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ হাওড়া ও কাটাখালের দুটি বাঁধের বর্তমান অবস্থা খতিয়ে দেখতে জলসম্পদ দফতরকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন৷ এছাড়াও দিনরাত নজরদারী রাখতে দফতরের উদ্যোগে টিম গঠন করে কাজ শুরু করতে বলেছেন তিনি৷ টেলি যোগাযোগব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ্ রাখতে বি এস এন এল-কেও একটি টিম গঠন করতে মুখ্যমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন৷ এক্ষেত্রে প্রশাসনের তরফ থেকে বি এস এন এল-কে কোনও ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হলে মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন তিনি৷
পর্যালোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান সচিব ডা আর সারোয়াল ও এম নাগারাজু, সচিব এস ভৌমিক, পশ্চিম জেলার জেলা শাসক ও পুলিশ সুপার এবং বিদ্যুৎ রাজস্ব জলসম্পদ প্রভৃতি দফতর ও বি এস এন এল-এর পদস্থ আধিকারিকরা৷
সভায় পশ্চিম জেলা সহ সারা রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা ও মোকাবিলায় প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে পর্যালোচনা হয়৷ স্বাস্থ্য দফতরের সচিব জানান, আগরতলা পুর নিগম এলাকায় চারটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে৷ প্রতিটি টিমে একজন ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট এবং দুজন এম পি ডব্লু রয়েছেন৷ প্রতিটি টিমেই পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজনীয় ঔষুধপত্র, হ্যালোজেন টেবলেট, ব্লিচিং পাউডার প্রভৃতি রয়েছে৷ এছাড়াও দিনরাত চবিবশ ঘন্টা তদারকির জন্য একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে৷
রাজস্ব দফতরের পক্ষ থেকে সভায় জানানো হয়, এখানে পর্যন্ত রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বন্যা কবলিত পশ্চিম ত্রিপুরা, খোয়াই ও সিপাহীজলা জেলায় খোলা হয়েছে ৬৮ টি ত্রাণ শিবির৷ এর মধ্যে পশ্চিম জেলাতে ৫৩টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে এবং এগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে ৯৬৭৮ টি পরিবার৷ আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে আজ সকাল সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত আগরতলা শহর ও শহর সংললগ্ণ এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৮০৯ মিলিমিটার৷
এদিকে আজ সন্ধ্যায় মহাকরণে রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা ও এর মোকাবিলায় প্রশাসনিক পদক্ষেপ সম্পর্কে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন রাজস্বমন্ত্রী বাদল চৌধুরী৷ তিনি বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণও বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ তিনি জানান, এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত কোনও প্রাণহানির খবর নেই৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *