প্রধানমন্ত্রীর হাতে জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ হল দেশের সর্ববৃহৎ ধলা-শদিয়া নদীসেতু

ধলা (অসম), ২৬ মে, (হি.স.) : অসমের ইতিহাসে নয়া অধ্যায় রচনা করে শুক্রবার বহু প্রতীক্ষিত ধলা–শদিয়া নদীসেতুকে জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই সঙ্গে ‘ধলা–শদিয়া দলং’ (অসমিয়া ভাষায় ‘দলং’-এর বাংলা তর্জমা ‘সেতু’) নামে পরিচিত এই সেতুকে সুধাকণ্ঠ ‘ভূপেন হাজরিকা’র নামে কেন্দ্রীয় সরকার সমর্পন করেছে বলে প্রদত্ত উদাত্ত বক্তব্যে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ‘ভূপেন হাজরিকা’র নামে ‘ধলা-শদিয়া সেতু’কে উৎসর্গ করায় অসমের প্রথমসারির জঙ্গি সংগঠন আলফা-স্বাধীনের প্রধান পরেশ বরুয়া থেকে শুরু করে রাজ্যের সব মহল থেকে মোদীকে ধন্যাবাদ জানানো হচ্ছে।

অসমের রাজ্যপাল বনোয়ারিলাল পুরোহিত, কেন্দ্রীয় ভূতল পরিবহণমন্ত্রী নীতিন গডকড়ি, মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল, অরুণাচল প্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী চাওনা মেইন, অসমের দুই মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য, পল্লবলোচন দাস, সাংসদ কামাখ্যাপ্রসাদ তাসা, রামেশ্বর তেলি, বলিন চেতিয়া-সহ বেশ কয়েকজন বিধায়ক, মুখ্যসচিব ভিকে পাপারসেনিয়া প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে লাল ফিতা কেটে এশিয়ার বৃহত্তম ৯.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ফিতা কেটে গাড়ি চড়ে যাচ্ছিলেন সেতুর ওপর দিয়ে। আচমকা গাড়ি থেকে নেমে প্রটোকল ভেঙে একা একা সেতুর ওপর দিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে চলে যান, উৎফুল্ল চিত্তে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকেন। সেতুর রেলিঙের কাছে গিয়ে নীচে ব্রহ্মপুত্রের প্রবহমান জল দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। সেখান থেকেই বহু দূরে দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে ঊর্ধ্ববাহু হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতেও ভুলেননি নরেন্দ্র মোদী।

অসমিয়া ভাষায় বক্তব্য শুরু করে প্রথমেই মানুষের মন জয় করেন তিনি। বলেন, ‘সমূহ অসমবাসীক অভিনন্দন জনাইছো, উপস্থিত ৰাইজক শুভেচ্ছা জনাইছো। মোৰ জন্ম গুজৰাটত। তাতেই শুনিছিলো শদিয়াৰ কথা’। অর্থাৎ সমস্ত অসম বাসীকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি, উপস্থিত জনতাকে আমার শুভেচ্ছা। আমার জন্ম গুজরাটে। সেখানেই আমি শদিয়ার কথা শুনেছিলাম। বলেন, মহাভারতের যুগের ‘কুণ্ডিল রাজ্যে’ এসেছি। এ আমার সৌভাগ্য। কেননা ভগবান কৃষ্ণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল কুণ্ডিল রাজ্যের। রুক্মিণী ছিলেন এই রাজ্যের কন্যা।

কংগ্রেসের পোঁতা গাছ আজ ফলেফুলে ভরেছে, এর ফসল লাভ করে বিজেপি কৃতিত্ব নিচ্ছে বলে কংগ্রেসের দাবিকে ঠুকরে দিয়ে স্বভাবসুলভ ভাষণে মোদী বলেন, ‘আসলে ২০০৩ সালের ১৯ মে তদানীন্তন এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর কাছে এখানে ধলা-শদিয়া সংযোগ রক্ষাকারী একটি সেতু নির্মাণের প্ৰস্তাব দিয়েছিলেন স্থানীয় বিধায়ক জগদীশ ভূঞা। এই প্রস্তাবে এখানে সেতু তৈরির উপযোগী ফিজিবিলিটি সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিল বাজপেয়ী সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ২০০৪ সালে বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। তারা এখানে সেতু নির্মাণে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। সে সময় যদি এনডিএ ক্ষমতায় আসত তা হলে এই সেতু তৈরিতে ১৪ বছর সময় লাগতো না। এবার জনতা বিজেপিকে সেই সুযোগ করে দেওয়ায় আখেরে আমজনতার লাভ হচ্ছে। কেন্দ্র ও অসমে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধলা-শদিয়া সেতু নির্মাণের কাজ ক্ষিপ্রগতিতে শেষ করার সংকল্প নেওয়ায় আজ তার ফল লাভ হল। উল্লেখ্য, এই সেতুর কাজ তাঁদের আমলে শুরু হয়েছিল বলে সম্প্রতি জোরগলায় দাবি তুলেছেন কংগ্রেস নেতারা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ থেকে এই সেতু অসম–অরুণাচলকে নতুন দিশা দেবে। নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। প্রতিবেশী দুই রাজ্যের আৰ্থিক বিকাশে যারপরনাই সহায়তা করবে এই সেতু। কেবল তা-ই নয়, অৰ্থনৈতিক বিপ্লবের সূচনাও করবে এই সেতু। শদিয়ায় উৎপাদিত আদার বাজার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাবে। এখানকার আদা চাষীদের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। গোটা দেশ আজ ধলা–শদিয়ার কথা জানলো। দেশ ছাড়িয়ে এশিয়ার দীৰ্ঘতম সেতুর ওপর দেশবাসীর দৃষ্টি আজ। উন্নয়নের দিকে দেশ আজ কতটুকু এগলো তার এক প্ৰতিচ্ছবি এই সেতু।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ থেকে এই সেতু চালু হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিনের দশ লক্ষ লিটার ডিজেল খরচাও বেঁচে যাবে। কেন না, আগে ইঞ্জিনচালিত ফেরিতে ব্রহ্মপুত্র পার হতে হত। তাছাড়া প্ৰতিকূল আবহাওয়ার জন্য বর্ষার দিনে ব্রহ্মপুত্র রুষ্ট হয়ে উঠলে ফেরি সেবাও বন্ধ হয়ে যেত। এখন থেকে ৩৬৫ দিনের ২৪ ঘণ্টাই অবিরাম যোগাযোগ হবে এর ওপর দিয়ে। এই নদীপথে ১৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। এপার-ওপার হতে প্রায় পাঁচঘণ্টা সময়ও বাঁচার পাশাপাশি যাতাযাত খরচাও বহু গুণে কমে যাবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তাছাড়া জল পরিবহণের ক্ষেত্ৰেও নতুন দিক উন্মোচিত হবে বলে জানান তিনি। বলেন, ফাইবার নেটওয়াৰ্কিং, নৌকা চলাচলের সুবিধা বাড়ানো হবে। ধলা-শদিয়া সেতু চালু হয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগের ব্যাপক সুবিধা বাড়বে। এতে এ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষজনের ব্যবসা-বাণিজ্যও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। এই সেতু অসমের পাশাপাশি অরুণাচল প্রদেশ তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে এবং উৎসাহব্যঞ্জক হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

অসমকে উৎকৰ্ষের কেন্দ্ৰ হিসেবে গড়ে তোলা তাঁর অন্যতম স্বপ্ন বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসমকে ‘এ ফর আসাম’ হিসেবে গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য। অসমে সনোয়াল সরকার সবদিকে এগিয়ে চলেছে। দুৰ্নীতিমুক্ত প্রশাসন দিতে বদ্ধপরিকর রাজ্য সরকারের কাজের ফলও ইতিমধ্যে রাজ্যের মানুষ পাচ্ছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

উল্লেখ্য, ধলা-শদিয়া সেতু সেনাবাহিনীকে উপকৃত করবে। অরুণাচল প্রদেশ হয়ে চীন সীমান্তে পৌঁছতে সময় বহু কম লাগবে। ৬০ টন বহনক্ষম সেতুর ওপর দিয়ে সেনাবাহিনীর ট্যাংকারও অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। ভারতের প্রতিরক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সেতুটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *