নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৩ জানুয়ারী৷৷ অল্পেতে ভয়াবহ দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেল ত্রিপুরা৷ মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৩৯

মিনিটে কেঁপে উঠে রাজ্য৷ রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৫.৭৷ আনুমানিক ১৩ থেকে ১৪ সেকেন্ড স্থায়িত্ব ছিল ভূমিকম্পের৷ তবে, সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল এদিনের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল রাজ্যের ধলাই জেলায়৷ ত্রিপুরার ইতিহাসে এই প্রথম কোন ভূমিকম্পের উৎসস্থল রাজ্যের একটি অংশের ভূগর্ভ৷ বিমানবন্দরস্থিত আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, ধলাই জেলার কমলপুর-কুমারঘাট সড়কে কালাঝাড়ি এলাকায় ভূমিকম্পের উৎপত্তি৷ ভূপৃষ্ট থেকে ২৮ কিলোমিটার গভীরে এই কম্পনের উৎপত্তি হয়েছে৷ এর আগে ১৯৫০ সালে রাজ্যে যে ভূমিকম্প হয়েছিল রিখটার স্কেলে তার তীব্রতা ছিল ৮.৬৷ যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ তীব্রতার ভূমিকম্প ছিল৷ এরপর থেকে রাজ্যে যতবার ভূমিকম্প হয়েছে, সবগুলিকে পিছনে ফেলে দিয়ে আজকের কম্পনের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি৷ ভূতত্ববিদদের মতে, ভারত এবং ইউরেশিয়া প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের কারণেই এই ভূকম্পনের সৃষ্টি৷ ক্রমাগত ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেইট কাছাকাছি চলে আসার পরিনামে এই এলাকা ভূমিকম্প প্রবণ জোন হিসেবে বিপজ্জনক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে৷ এই প্লেইটগুলি ক্রমাগত কাছে চলে আসা আগামীদিনে রাজ্যের চিন্তা আরও বাড়াল বলেই মনে করছেন ভূতত্ববিদরা৷
এই ভূমিকম্পের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে মায়াছড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্যা কমলিনি কান্দা(৪০) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন৷ এছাড়াও রূপক দেব (৪৫) ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে৷ তাঁকে স্থানীয় আর জি এম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন৷ এদিনের ভূমিকম্পের ঘটনায় আরও তিনজন আহত হয়েছেন৷ তাদের অবশ্য প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে৷ এদিকে, বহু বাড়িঘর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ সরকারী মতে, ধলাই জেলায় ৫টি মাটির ঘর আংশিক ভেঙ্গে গেছে৷ কমলপুর এবং সালেমা থানায় ফাঁটল দেখা দিয়েছে৷ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ঊনকোটি জেলায়৷ সরকারী হিসেব অনুসারে, কুমারঘাট মহকুমার পেচারথলে ২৪টি মাটির ঘর আংশিক এবং ৫টি মাটির ঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ সেখানে অবশ্য হতাহতের কোন খবর নেই৷ ভূমিকম্পে ধস পড়েছে আসাম-আগরতলা জাতীয় সড়কেও৷ লংতরাই পাহাড়ের ছামনু থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে এদিন ভূমিকম্পের পর ধস নামে৷ অবশ্য, মহকুমা প্রশাসন এবং টিএসআর মিলে কিছুক্ষণের মধ্যে সড়ক পরিস্কার করে ফেলে৷
জানা গেছে, এদিন ভূমিকম্পের সময় ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে যাওয়ার সময় আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হন মাছমারা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্যা কমলিনি কান্দা (৪০)৷ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন৷ অন্য আরেকটি ঘটনায়, এদিন কৈলাসহরের বিমল সিন্হা কমপ্লেক্সে বসবাসকারী রূপক দেব(৪৫)ও ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন৷ তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় আরজিএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ এদিকে, মাথায় বাঁশ পড়ে কৈলাসহরের দারচৈ গ্রামের বাসিন্দা ডিয়া ডার্লং(৩৮) গুরুতর আহত হয়েছে৷ পশ্চিম জেলার মোহনপুর মহকুমা বউলিয়া কৃষ্ণ মন্দির এলাকায় মাটির দেওয়াল খসে পড়ে রত্না গোপ(৩০) এবং তার স্বামী বিষ্ণু গোপ(৩২) আহত হয়েছেন৷ আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷

ভূমিকম্পে বহু ক্ষয়ক্ষতির খবর মিলেছে৷ রাজধানী আগরতলায় জহর ব্রীজে ফাটল দেখা দিয়েছে৷ এছাড়াও রাজ্য সচিবালয়ের কয়েকটি অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে৷ সরকারী মতে, ধলাই জেলার কমলপুর মহকুমার দূর্গা চৌমুহনী ব্লকে ৪টি এবং সালেমা ব্লকে ১টি মাটির ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ কমলপুর এবং সালেমা থানায় ফাটল দেখা দিয়েছে৷ এছাড়া ঊনকোটি জেলার কুমারঘাট মহকুমার পেচারথলে উত্তর মাছমারা, রামগুনা পাড়া, দক্ষিণ মাছামারা এবং উত্তর ধনিছড়ায় ৫টি মাটির ঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আরও ২৪টি মাটির ঘর৷ মুখ্যসচিব যশপাল সিং জানিয়েছেন, জেলাশাসকদের বলা হয়েছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কত জানানোর জন্য৷ ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে৷ বেসরকারী হিসেব অনুসারে ধলাই জেলাতেই শতাধিক ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে৷ এছাড়াও, প্রায় ৮ জন সামান্য আহত হয়েছেন বলেও সূত্রের দাবি৷ তাদের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে৷ কমলপুর কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক এবং আমবাসাস্থিত আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কেও ফাটল দেখা দিয়েছে বলে সূত্র অনুসারে জানা গেছে৷
এদিকে, ভূমিকম্পের সময় উমাকান্ত সুকলে ছাত্ররা দৌড়ে বেরুতে গিয়ে দুই ছাত্র আতঙ্কিত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে৷ সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাবা-মা’কে খবর দেওয়া হলে তারা ঐ দুই ছাত্রকে বাড়ি নিয়ে যান৷ জানা গেছে, দুই ছাত্রই এখন সুস্থ আছে৷ ধলাই জেলায় এক ব্যাক্তির ঘর ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়েছে বলে জানা গেছে৷ এলাকাবাসী সূত্রে খবর, ধলাই জেলার আমবাসা মহকুমার কুলাই’র বাসুদেব পাড়ায় ছাতুই মগের বাড়ি ভূমিকম্পে ভেঙ্গে গেছে৷ ভূমিকম্পের সময় ঘরের ভেতর কেউ ছিলেন না, তাই কারোর কোন ক্ষতি হয়নি৷
ঘুরে ফিরে প্রতিবছরই কোন না কোন সময়ে রাজ্যে ভূমিকম্প হচ্ছে৷ দেশের মধ্যে ভূমিকম্প প্রবণ সর্বাধিক ঝঁুকিপূর্ণ রাজ্য হিসেবে চিহ্ণিত ত্রিপুরা৷ আজকের ঘটনা রাজ্যের জন্য চিন্তা আরও বাড়িয়েছে৷ আবহাওয়াবিদদের মতে, এদিনের ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব আরো কিছুক্ষণ হলে ভয়াবহ দূর্যোগ নেমে আসত রাজ্যে৷ উৎপত্তিস্থল যেহেতু এরাজ্যেই সেক্ষেত্রে প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বেশি অনুভূত হয়েছে৷ ফলে, আজকের ভূমিকম্প আগামীদিনের জন্য রাজ্যবাসীর চিন্তা বাড়াল৷