ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করিয়া দেয়৷ ক্ষমতা হারানোর বেদনা যে কতখানি দুঃসহ তাহা হয়তো অনেকেই সেই ভাবে অনুভব করিতে পারেন না৷ বিরোধী দলনেতা বা বিরেধী কংগ্রেস দল মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া দিয়াছেন৷ প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা হত্যার দায় চাপানো হইয়াছে মুখ্যমন্ত্রীর উপর৷ এই অভিযোগ তোলা মাত্রই সিপিএম দলও তেলে বেগুনে জ্বলিয়া উঠিয়া বিরোধী সুদীপ রায় বর্মন, রতন নাথদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছঁুড়িয়া দিয়াছেন৷ প্রমাণ করিতে না পরিলে তাহাদের পদত্যাগ করিতে বলিয়াছেন৷ বিমল সিনহার খুনের পিছনে কাহাদের হাত, লক্ষ্য কি, এই সব বিষয় ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয় নাই৷ কিন্তু যাহা স্পষ্ট হইয়াছে তাহা তো মারাত্মক৷ তদন্তের কাজে রাজ্য সরকার সহযোগিতা করেন নাই এমন মন্তব্য করা হইয়াছে কমিশনের রিপোর্টে৷ পুলিশী সহায়তাও তেমন না পাওয়ার উল্লেখও আছে রিপোর্টে৷ এই সব ভূমিকায় রাজ্য সরকারের স্বচ্ছতার বিষয়ে অনেক বেশী বিতর্ক উঠিবারই কথা৷ অন্য দিকে, ষোল বছর এই রিপোর্ট তালা বন্দী করিয়া রাখা হইল কোন লক্ষ্যে? সুতরাং রাজ্য মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রীর হত্যার তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট চাপিয়া যাওয়ার ঘটনায় বামফ্রন্ট সরকারের বিশ্বাস যোগ্যতাই প্রশ্ণের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে৷ ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর বিরোধীরা যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে টার্গেট করিয়াছেন তাহা জনমনে কতখানি আলোড়ন আনিতে পারিবে? বিমল সিনহার মুখ্যমন্ত্রীত্ব আটকাইতেই কি তৎপর ছিলেন মানিক সরকার? সংসদীয় রীতি অনুযায়ী আইন বা বিধানসভার সংখ্যা গরিষ্ট সদস্যরাই নেতা বা মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করেন৷ তাহা বেশীর ভাগ দলেই তো খাটে না৷ একথা তো রাজনীতিকরা ভাল করিয়াই জানেন৷ সিপিএম দলে মুখ্যমন্ত্রী কে হইবেন তাহা দলই চূড়ান্ত করে৷ শুধু সিপিএম দল নহে৷ কংগ্রেস দলে তো হাইকমান্ডই শেষ কথা৷ মানিক সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বি হিসাবে বিমল সিনহা নিজে ভাবিতেই পারেন৷
বিমল সিনহা হত্যার দায় মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের উপর চাপাইয়া বিরোধী কংগ্রেস নেতারা রাজনীতির ফায়দা খুব বেশী ঘরে তুলিতে পারিবেন বলিয়া মনে হয় না৷ মনে হয় না দল ও মুখ্যমন্ত্রী ইহাতে বিচলিত হইয়াছেন৷ দল বিচলিত হইতে পারে এই কারণে যে, একজন মন্ত্রীর সঙ্গে উগ্রপন্থীদের সখ্যতার বিষয়টি সরকার মানিয়া নিল কিভাবে৷ মুখ্যমন্ত্রী, সরকার পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী মন্ত্রী ও জঙ্গী সংযোগকে মানিয়া নেওয়ার ঘটনায় রাজ্যে বাম সরকারকে ইউসুফ কমিশন কার্য্যত কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া দিয়াছেন৷ এই কারণে যদি বিমল হত্যার দায় সরকার ও পুলিশের উপর বর্তায় তাহা হইলে কি একেবারেই অসঙ্গত হইবে? রাজ্যে নৃপেন চক্রবর্তীর পর মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসানো হইল দশরথ দেবকে৷ তিনি তো ছিলেন অসুস্থ, শারীরিক ভাবে অক্ষম৷ উপমুখ্যমন্ত্রী পদে বৈদ্যনাথ মজুমদারকে বসাইয়া রাজ্যের প্রবীন নেতার যোগ্য সম্মান দেওয়া হইয়াছে৷ কিন্তু, কমিউনিস্ট সর্বহারার প্রতিভু নৃপেন চক্রবর্তীও লোভ লালসার উর্দ্ধে উঠিতে পারেন নাই৷ বরং তিনি দেখাইয়া দিয়াছেন একজন কমিউনিস্ট কতখানি ক্ষমতা লোভী হইতে পারে৷ তিনি প্রকাশ্যে দল বিরোধী বক্তব্য রাখিয়া সিপিএমের বর্ষিয়ান নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলিয়া পরিস্থিতি ভয়ানক করিয়া তুলিয়াছিলেন৷ বাধ্য হইয়া পার্টি অন্তপ্রাণ নৃপেন চক্রবর্তীকে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বহিস্কার করিয়াছিল৷ এই যখন অবস্থা তখন বিমল সিন্হা আঠার জন বিধায়কের সমর্থন নিয়াও মুখ্যমন্ত্রী হইতে না পারায় আক্ষেপ করিয়া কি কোনও ফায়দা হইতে পারে?
মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি কোন্ নীতি ও লক্ষ্য নিয়া দলা চালাইবে তাহা সেই দলের বিষয়৷ তবে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত না করিয়া ত্রিপুরা রাজ্যকে বাঁচাইয়া দিয়াছেন৷ ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উগ্রপন্থীদের সখ্যতা ও মাখামাখির বিষয়ে যাহা বলা হইয়াছে তাহা তো তেমন গোপন ছিল না৷ আর এই কারণে রাজ্যের বৃহত্তর অংশের মানুষ এক সময় ধরিয়াই নিয়াছিল যে, রাজ্যে উগ্রপন্থীর জন্মদাতা সিপিএম৷ এই ধারণা পাল্টাইতে সিপিএমকে অনেক মূল্য দিতে হইয়াছে৷ বলিতে দ্বিধা নাই, ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে অনেক তথ্যই উঠিয়া আসে নাই৷ সরকার আন্তরিক ভাবে কমিশনকে সহায়তা দেয় নাই৷ পুলিশও কোনও রিপোর্ট দিয়া ইউসুফ কমিশনকে সাহায্য করে নাই৷ এমন অভিযোগ আরও বেশী সংশয় সন্দেহ সৃষ্টির সুযোগ করিয়া দিয়াছে৷
বিরোধী কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে টার্গেট করিয়া বোধহয় রাজনীতির পাটিগণিতে ভুল করিয়াছেন৷ ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে সরকারকে বিঁধিয়াছে৷ সরকারের প্রধান হিসাবে খুব স্বাভাবিক ভাবে মানিক সরকার দায়িত্ব এড়াইতে পারেন না৷ একথা স্বীকার না করিয়া বোধহয় উপায় নাই যে, কার্য্যত সরকার চালায় ক্ষমতাসীন দল৷ প্রয়াত মন্ত্রী বিমল সিনহাও দলের বাহিরে ছিলেন না৷ মুখ্যমন্ত্রী মানিকবাবুও দলের নির্দেশ নতমস্তকে মানিতে বাধ্য৷ এই যখন প্রকৃতই সিপিএম বা রাজ্য সরকারের অবস্থা সেখানে বিমল সিনহা হত্যায় মানিক সরকারকে এককভাবে দায়ী করার মধ্যে তেমন যুক্তি খাড়া করা যাইতে পারে না৷ ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে যেভাবে প্রয়াত বিমল সিনহা সম্পর্কে মন্তব্য করা হইয়াছে তাহা রাজ্যবাসীর পক্ষে চরম দুর্ভাগ্যের৷ একজন মন্ত্রীর উগ্রপন্থীদের সঙ্গে দোস্তি আছে৷ যে উগ্রপন্থীরা এরাজ্যে বিভিষিকার রাজত্ব কায়েম করিয়াছে৷ হাজার হাজার লোককে খতম করিয়াছে৷ গৃহদাহ, গণহত্যা, হামলা, অপহরণে একসময় ত্রিপুরা ছিল সন্ত্রস্ত৷ চরম নিরাপত্তাহীনতায় কাটাইতে হইত রাজ্যবাসীকে৷ সেই বিমল সিনহার পিছনে ১৮ জন বিধায়কের সমর্থন ছিল মুখ্যমন্ত্রী হইবার জন্য? যদি তিনি মুখ্যমন্ত্রী হইতেন তাহা হইলে তো রাজ্যটা ছারখার হইয়া যাইত৷ এক্ষেত্রে মানিক সরকারকে টার্গেট করিয়া বিরোধীরা বোধহয় অনেকটা ভুল পথেই পা বাড়াইলেন৷ ইউসুফ কমিশন যেসব জ্বলন্ত বিষয়গুলি উল্লেখ করিয়াছেন তাহাতেই তো বাম সরকারের বা বামফ্রন্টের গলার স্বর অনেক নীচু হইবার কথা৷ এত বড় একটা ইস্যুতে কি কংগ্রেস জল ঢালিয়া দিল না? রাজ্যে ভবিষ্যতের স্বপ্ণ দেখা বিজেপি তো কার্য্যত মৌনব্রতই চালাইয়া যাইতেছে৷ এরাজ্যে কংগ্রেসের হাল তো বেহাল৷ বঙ্গে দোস্তি, রাজ্যে কুস্তি হইবে কিভাবে? কংগ্রেস তো এখন আর লোক টানিয়া ‘বিপ্লব’ দেখাইবার পথে নাই৷ আগামী দিনে এই ত্রিপুরাতে কংগ্রেস সিপিএম দোস্তির পথও খোলা রাখা হইল৷ দলকে বা সামগ্রিক ভাবে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করাইয়া মুখ্যমন্ত্রীকে টার্গেট করিয়া কংগ্রেস কি বিষয়টিকে ভিন্নমুখী করিতে চাহিয়াছে? অনেক দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সরকারী আবাসে মহিলার কঙ্কাল উদ্ধার প্রচারে নিয়া কংগ্রেস সুবিধা করিতে পারে নাই৷ রাজনীতির পাটিগণিত সম্পর্কে রাজ্যের মানুষ অনেক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হইয়াছেন৷ এখানে সস্তায় বাজিমাৎ করিবার সুযোগ কম৷ রাজ্যের কংগ্রেস কাহার পক্ষে? রাজনীতির গতিপথ কি? কথায় আছে ‘যে নালে উৎপত্তি সেই নালেই বিনাশ’৷
2016-03-30