কেউ জানিয়া বুঝিয়া বা কেউ অজান্তেই সর্বনাশের বীজ পঁুতিয়া দেন অথবা আগুনে ঘি ঢালিয়া সব ছারখার করিতে পারেন৷ ঊনিশশ আশী সালে পাহাড়ী বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নজীরবিহীন দাঙ্গায় ত্রিপুরা রক্তে ভাসিয়াছে৷ উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তিল তিল করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহা নিমেষেই বিপর্য্যস্ত হইবার ঘটনা হইতে যে শিক্ষা নিবার কথা ছিল, তাহা আমরা বিস্মৃত হইয়াছি৷ আবার সেই উস্কানীর চেষ্টা যে হইতেছে না তাহা জোর দিয়া বলা মুশকিল৷ একুশে জানুয়ারী পূর্ণরাজ্য দিবসের অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল তথাগত রায় ত্রিপুরায় আশী সালের ভয়াবহ দাঙ্গার পিছনে বাংলাদেশ হইতে আগত জনবিন্যাসকেই দায়ী করিয়াছেন৷ এরাজ্যে আশী সালের দাঙ্গার পিছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আরও অনেক কারণ সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে৷ কিন্তু, রাজ্যপাল বাংলাদেশ হইতে আগতদের যেভাবে দায়ী করিয়াছেন তাহা আগামী দিনে তো নানা সমস্যার দিকেই ঠেলিয়া দিবে৷ মাননীয় রাজ্যপাল যদি আশী সালের দাঙ্গার জন্য বাংলাদেশ হইতে আগত জনবিন্যাসকে দায়ী করিয়া থাকেন তাহা হইলে নতুন করিয়া প্রশ্ণ উঠিবেই৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হইয়াছে৷ শরণার্থীরা ঘরে ফিরিয়া গিয়াছে৷ চোরাপথে বহু পাকিস্তানী বা বাংলাদেশী রাজ্যে বেআইনী অনুপ্রবেশ এখনও যে করিতেছে না বলা মুশকিল৷ তাহার সংখ্যা কি সরকারীভাবে দেওয়া সম্ভব হইবে? এখনও সেই ধারার কোনও পরিবর্তন হইয়াছে বলা যাইবে না৷ রাজন্য আমল হইতেই এই পার্বতী ত্রিপুরায় বাঙালীরা আদর অভ্যর্থনায় বসবাস করা শুরু করিয়াছেন৷ বর্তমান ত্রিপুরায় রাজার যে রাজত্ব সেখানে গরীব উপজাতি অংশের মানুষের তো কোনও কর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না৷ রাজার রাজত্ব চলিত চাকলা রোশনাবাদ এলাকার সংগৃহীত কর হইতে৷ রাজার রাজত্ব প্রসারিত ছিল ওই এলাকা পর্য্যন্ত৷ কিন্তু প্রশাসনিক ও বাণিজ্যের সুবিধার জন্য ইংরেজ সরকার এই ভূখন্ড ব্যবহার করিত৷ সেই চাকলা রোশনাবাদের সংগৃহীত রাজস্ব বা কর রাজার রাজত্বের ব্যয় ভার মিটিত৷ যেহেতু চাকলা রোশনাবাদ এলাকা ছিল রাজার অধীন, সেই বৃহত্তর ত্রিপুরায় তো উপজাতিরা সংখ্যা গরিষ্ট ছিল না৷ অথচ বার বার বলা হইতেছে সংখ্যা গরিষ্ট উপজাতিরা সংখ্যা লঘিষ্ট হইয়া পড়িয়াছেন৷
১৯৭১ সাল হইতে ১৯৮০ সাল এই ৯ বৎসর উপজাতিদের মনে ক্রমাগত হিংসায় ইন্ধন দেওয়া হইয়াছে৷ তাহাই সম্প্রীতির বন্ধনকে ছিন্ন করিয়াছে৷ জাতি উপজাতি উভয় অংশের মানুষের মনে প্রতিনিয়ত বিষবাষ্প কাহারা ছড়াইয়াছে, ত্রিপুরাবাসীর অজানা নহে৷ রাজ্যে উপজাতিদের মন পাইতে, নিজেদের উপজাতি দরদী হিসাবে প্রমাণ করিতে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হইয়া যায়৷ একদিকে আঞ্চলিক দলগুলির দাবী দাওয়ার আন্দোলন৷ অন্যদিকে, সিপিএম নেতাদের মধ্যেও উপজাতিদের মধ্যে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াইতে বিপ্লবী আওয়াজ উঠে ও হিংসার বীজ রোপণ হইতে থাকে৷ ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধীর ভরাডুবি ত্রিপুরায় ইন্দিরা বিদ্রোহী শচীন্দ্র লাল সিংহের সিএফডি দলে যোগদানের ফলে রাজ্যে কংগ্রেস ধরাশায়ী হয়৷ সিএফডি ও জনতাকে নিয়া দুইবার কোয়ালিশন সরকার গড়ে সিপিএম৷ সবই ছিল তখন কৌশলের খেলা৷ ১৯৭৮ সালে বিপুল সংখ্যা গরিষ্টতা নিয়া সিপিএম বা বামফ্রন্ট রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে৷ বামেদের ক্ষমতা দখলের দুই বছরে কি এমন ঘটিল যে, ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায় ত্রিপুরা তছনছ হইয়া গেল? আসলে, রাজনৈতিক দলগুলি মেকি উপজাতি দরদের প্রতিযোগিতা শুরু করিয়া ছিল৷ ১৯৭৮ সালেই রাজ্যে উগ্রপন্থী সংগঠন জন্ম শুরু হয়৷ যুব সমিতির নেতা আত্মগোপন করিয়া টিএনভি নামে উগ্রপন্থী সংগঠন গঠন করিলেন৷ একের পর এক উগ্রপন্থী সংগঠনের জন্ম ঘোষণা ও স্বাধীন ত্রিপুরার শ্লোগান তুলিয়া মানুষ খুন করার প্রতিযোগিতা শুরু হইয়া যায়৷ মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী সেই সময় উপজাতি দরদ দেখাইতে গিয়া বলিয়াছিলেন ‘আমি যদি উপজাতি হইতাম তাহা হইলে উগ্রপন্থী হইতাম’৷ শুধু নৃপেন চক্রবর্তী নহে অন্যান্য আঞ্চলিক দলের নেতারা প্রায় প্রকাশ্যে উগ্রপন্থাকে উৎসাহিত করিয়া চলিয়াছিলেন৷ উপজাতি উগ্রপন্থীদের ক্রমাগত অপরহণ বাণিজ্য, হামলা, গণহত্যা ইত্যাদির ঘটনায় ত্রিপুরায় বারুদের স্তুপ বাড়িতে থাকে৷
রাজনৈতিক দলগুলির একের পর এক উস্কানী, উপজাতিদের মধ্যে একের পর এক বিষ ঢালিয়া উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই সন্দেহের আবহ ছড়াইয়া দেওয়া হয়৷ উগ্রপন্থীদের আত্মসমর্পণের নামেও তো রাজ্যে কম রাজনীতি হয় নাই৷ ত্রিপুরার মানুষ তাহা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছেন৷ একের পর এক উস্কানী, উপজাতিদের দলে টানার কৌশল ইত্যাদির কারণে রাজ্যে সংকীর্ণ রাজনীতিই অবিশ্বাসের জন্ম দেয়৷ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সামান্য স্ফুলিঙ্গ দাবানলের সৃষ্টি করে৷ বাংলাদেশ হইতে অনুপ্রবেশ বা জনবিন্যাসের কারণে ১৯৮০ সালে দাঙ্গা হইয়াছে৷ রাজ্যপালের এই মন্তব্য নিয়া বিতর্ক আছে৷ সোজা কথায় রাজনীতির ব্যাপারীরাই রাজ্যে জাতি উপজাতির মধ্যে দাঙ্গার আগুন লাগাইয়াছে৷ আশী সালের এই দাঙ্গা রাজনৈতিক ধান্দাবাজীর ফসল৷
2016-01-23